ডিজিটাল পর্দার নেশায় অন্ধ হচ্ছে বইয়ের ভবিষ্যৎ
মুক্তমত
প্রকাশঃ ২১ অক্টোবর ২০২৫
রাতের নিস্তব্ধতায় এখন আর শোনা যায় না পড়ার টেবিলে পাতা উল্টানোর শব্দ, কিংবা মুখে মুখে কবিতা পড়ার ছন্দ। বইয়ের গন্ধে ভরা শৈশব হারিয়ে গেছে ডিজিটাল মোবাইলের ঝলমলে পর্দার আলোয়। যে ঘরে একসময় মায়ের কণ্ঠে ধ্বনিত হতো—“পড়তে বসো, পরীক্ষা সামনে—সেই ঘর এখন ইউটিউবের আওয়াজ, টিকটকের গান আর গেমের চিৎকারে মুখর।
শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ছে এই চিরচেনা বাক্যটি এখন যেন শুধু পাঠ্যবইয়ের পাতায় বন্দী নিঃশব্দ স্মৃতি। ৫ আগস্টের পর দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় যে অস্থিরতা ও ভাঙন তৈরি হয়েছে, তা শুধু শিক্ষার নয়, জাতির বিবেকেরও ভাঙন।
শিক্ষাবিদদের মতে, আজকের প্রজন্ম বইয়ের অক্ষরের চেয়ে স্ক্রিনের আলোর প্রতি বেশি আকৃষ্ট। সেই আলো দেখতে ঝলমলে হলেও এর আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর অন্ধকার—যেখানে বই হারাচ্ছে স্থান, শিক্ষা হারাচ্ছে মূল্যবোধ, আর মানুষ হারাচ্ছে মানবিকতা।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের ৫৬ শতাংশের হাতে মোবাইল ফোন। ঢাকায় এ হার ৬২ শতাংশেরও বেশি। মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রতিদিন মোবাইল ব্যবহার করে। এতে দেখা দিচ্ছে চোখের সমস্যা, ঘুমহীনতা, মনোযোগহীনতা ও মানসিক অস্থিরতা।
মোবাইল ও ইন্টারনেটের প্রভাবে পড়াশুনা যে অনেক দূরে তোফায়েল মিয়া নামে নবম শ্রেণির ছাত্রের ভাষ্যে তা স্পষ্ট। তোফায়েলের ভাষ্য “আগে বই পড়তাম, এখন মোবাইল ছাড়া সময় কাটে না।”মা-বাবারাও পড়ার কথা তেমন একটা বলেন না। অভিভাবকদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে ভয়াবহ উদাসীনতা। অনেকেই বলেন, “এসএসসি পাস করলেই ইউরোপ পাঠাবো—বেশি পড়াশোনার দরকার নেই।” ফলে সন্তানদের বইয়ের প্রতি অনাগ্রহ আরও বাড়ছে।
আজ পরিবারের প্রতিটি সদস্য নিজ নিজ মোবাইলের জগতে বন্দী। বাবা ব্যস্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, মা অনলাইন নাটক বা শপিংয়ে, সন্তান গেম আর চ্যাটে। ফলে বই পড়া, গল্প করা কিংবা পারিবারিক আলোচনার মতো সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সম্পদ কান্তি দাস তালুকদারের বলেন, “পরিবারের অবহেলা, শিক্ষকের প্রতি অবাধ্যতা ও মোবাইল আসক্তি—এই তিনটি কারণ শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।” বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বলছেন, শিক্ষার্থীদের মনোযোগে এখন বই নয়, স্ক্রিনই প্রধান।
এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ক্লাসে পড়াতে গেলে অনেকে গল্প করে, হাসাহাসি করে, এমনকি শিক্ষকের সঙ্গে অশালীন আচরণও করে।”
বই বিমুখতা শুধু পরীক্ষার ফলাফলেই নয়, শিক্ষার্থীদের আচরণেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। কিশোর গ্যাং, মাদক, সহিংসতা—সবকিছু বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, “এই প্রবণতা নৈতিকতা হারানো প্রজন্ম তৈরি করছে।”
প্রবীণ শিক্ষকরা সতর্ক করছেন—যদি পরিবারে বইয়ের পরিবেশ না ফেরে, শিক্ষককে যদি সম্মান না দেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে প্রযুক্তিনির্ভর কিন্তু মূল্যবোধহীন।
শিক্ষা কেবল পরীক্ষার ফল নয়—এটি জাতির আত্মা। সেই আত্মা আজ মোবাইলের নীল আলোয় মলিন। এখনই সময় জেগে ওঠার। পরিবারে বই পড়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, মা–বাবাকে হতে হবে সন্তানদের অনুপ্রেরণা, আর বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে পাঠের আনন্দ।
রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার—এই তিন স্তর একসঙ্গে কাজ না করলে, মোবাইলের নেশায় হারিয়ে যাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আর একদিন হয়তো আমরা নিজেরাই ভুলে যাব মানুষ হওয়ার শিক্ষা।
পড়ালেখা, নেশা, মোবাইল, এইচএসসি