ডিজিটাল পর্দার নেশায় অন্ধ হচ্ছে বইয়ের ভবিষ্যৎ
মুক্তমত
প্রকাশঃ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জীবনে প্রথম দেখা নদী সুরমা। সিলেট শহর থেকে গ্রামের বাড়ি গোলাপগঞ্জের লক্ষ্মীপাশা, নানার বাড়ি বালাগঞ্জের নীজ করনসি গ্রামে যেতে হলে ক্বীন ব্রিজ পাড়ি দিয়ে যেতে হতো। ক্বীন ব্রীজ হলো সুরমা নদীর উপর ১৯৩৬ সালে স্থাপিত একটি লোহার ব্রীজ। এই ক্বীন-ব্রীজ় সিলেটের অন্যতম দর্শনীয় এবং ঐতিহ্যবাহী স্থান। এই ব্রীজকে এক সময় সিলেট শহরের প্রবেশদ্বার বলা হতো।
ব্রীজটি ব্রিটিশ গভর্নর মাইকেল ক্বীন এর নামে নামকরণ করা হয়। আসাম প্রদেশের গভর্নর ছিলেন মাইকেল ক্বীন। তাঁর সিলেট সফরের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে এ ব্রীজ নির্মাণ হয়। আশির দশক পর্যন্ত ক্বীন-ব্রীজ ছিল উত্তর সুরমা ও দক্ষিণ সুরমার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী একমাত্র সেতু বা ব্রীজ়। সেই ক্বীন-ব্রীজ পাড়ি দেয়ার সময়ই জীবনের প্রথম নদী দেখা।
ক্বীন-ব্রিজ পাড়ি দেয়ার সময় রিকশাতে কারো না কারো কোলে বসা থাকতাম। কোলে বসেই শৈশবে প্রথম নদী দেখি, সুরমা দেখি।
সুরমা দেখার পূর্বে সুরমা নদী নিয়ে অনেক গল্প শোনা হয়। সুরমা নদী নিয়ে শোনা হয় কিছু গান। যা মনে দাগ কাটে।
পরিবারে ছিল ভাববাদী ইসলামের চর্চা। তাই শৈশবেই শোনা হয়- সুফী সাধক হযরত শাহজালাল (রহ) ও ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট বা শ্রীহট্র বিজয়ের গল্প। সে গল্পে ইতিহাসের উপাদান ছিল, আবার ছিল লোকগাঁথার আখ্যান।
সুরমা দেখার পূর্বে শুনেছিলাম হযরত শাহজালাল (রহ) জায়নামাজ বিছিয়ে ৩৬০ আউলিয়াকে নিয়ে এ নদী পাড়ি দিয়েছেন। সাত শত বছর পূর্বে প্রাচীন শ্রীহট্র রাজ্যের রাজধানীতে প্রবেশের মূল বাঁধা ছিল তখন সুরমা নদী। দরবেশ শাহজালাল সে বাঁধা জয় করেন।
জায়নামাজ বিছিয়ে সঙ্গী সাথিদের নিয়ে যে স্থান দিয়ে তিনি বর্তমান সিলেট নগরে প্রবেশ করেছিলেন- সে স্থানের নামকরণ হয় শেখঘাট। অর্থাৎ শায়েখের ঘাট। শৈশবে এ ঘাটেই প্রথম নৌকা চড়ে নদী পাড়ি দিয়েছিলাম। বড় চাচার সঙ্গে নৌকা চড়ে শেখঘাট থেকে বরইকান্দি যাই। বরইকান্দি শাহী মসজিদ, হাফিজ সুলতান (রঃ) এর মাজার ও সুলতানিয়া মাদ্রাসায় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। শেখঘাটে এখনো খেয়াঘাট আছে।
শেখঘাটে হযরত শাহজালাল (রহ)-এর সিলেট বিজয়ের ৭০০ বছর পূর্তিকে স্মরণ করে একটি তোরণ নির্মান করা হয়েছিল। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান-এর পরিকল্পনায় সুরমা নদীতীরে মোঘল স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত এই তোরণ একটি ল্যান্ডমার্ক হিসাবে পরিচিত। সুরমা নদীতীরের আরেকটি বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক হচ্ছে নবাব আলি আমজাদের ঘড়ি। আলী আমজাদের ঘড়ি বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঘড়ির টাওয়ার। টাওয়ারটি ১৮৭২ সালে পৃথিমপাসার নবাব আলী আহমদ খান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার পুত্র নবাব আলী আমজাদ খানের নামে নামকরণ করা হয়।
গানে সুরমা নদীর কথা প্রথম শুনি ফরিদা ইয়াসমিনের কন্ঠে "এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমা নদী তটে..." দেশাত্ববোধক গানে। আঞ্চলিক গানে শোনা হয় "সুরমা নদীর তীরে, আমার ঠিকানারে, বাবা শাহজালাল-এর দেশ ছিলট ভূমিরে"। সুরমা নদীর তীরে নিজের ঠিকানা থাকাকে সিলেটীরা গর্বের সাথে উচ্চারণ করে।
গণসঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গাওয়া বিখ্যাত গান "হবিগঞ্জের জালালী কইতর, সুনামগঞ্জের কুড়া / সুরমা নদীর গাংচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া / শূন্যে দিলাম উড়া রে ভাই যাইতে চান্দের চর / ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর, /তোমরা আমায় চিনোনি, তোমরা আমায় চিনোনি?"
দেশভাগের বেদনা নিয়ে লেখা এ গান পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়া প্রবাসী সিলেটীদের মধ্যেও বেদনারবোধ জাগায়। ফেলে আসা স্বদেশের চেনা নদীর জন্য মন উচাটন হয়। কেউ মন খারাপ করে সুরমা জন্য, কেউ কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, পিয়াইন, ধলাই, বাসিয়া, নলজুর, বৌলাই, বটের গাঙ সহ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্মৃতিময় ছোট নদীকে।
আসলে নদী মানুষের স্মৃতির মনিকোঠায় জায়গা করে নেয়া এক অমূল্য সম্পদ। নদীর সাথে যার জীবনের স্মৃতি নেই সে এক দূর্ভাগা।
সুরমা নদী নিয়ে গণমানুষের কবি দিলওয়ারের স্মৃতিমাখা বিখ্যাত কবিতা "ক্বীন ব্রীজে সূর্যোদয়"। এই কবিতা পাঠ করলে ক্বীন-ব্রীজ থেকে সুরমা নদীর সূর্যোদয় দেখার স্বাদ জাগতেই পারে। এই স্বাদ পূরণে ক্বীন-ব্রীজ থেকে এক প্রশান্ত ভোরে সূর্যোদয় দেখেছি।
ক্বীন-ব্রিজে সূর্যোদয়' কবিতায় কবি লিখেছেন, "এখন প্রশান্ত ভোর ঝিরঝিরে শীতল বাতাস/ রাত্রির ঘুমের ক্লান্তি মন থেকে ঝেড়ে মুছে নিয়ে/ আমাকে সজীব করে। উর্ধ্বে ব্যাপ্ত সুনীল আকাশ/ পাঠায় দূরের ডাক নিরাশ্রয়ী পাখিকে দুলিয়ে/ নিচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার।/ কান পেতে শুনি সেই অপরুপ তটিণীর ভাষা/ গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা/ সৃষ্টির পলিতে সেই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।/ সহসা ফিরিয়ে চোখ দিয়ে দেখি দূর পূবাকাশে/ তরুণ রক্তের মত জাগে লাল সাহসী অরুণ/ পাখির কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে/ দ্বীনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী কূরণ!/ ধারালো বর্ষার মতো স্বর্ণময় সূর্য রশ্মি ফলা/ ক্বীন-ব্রিজে আঘাত হানে শুরু হয় জনতার চলা।/"
কবি দিলওয়ার 'রক্তে আমার অনাদি অস্থি' কবিতায় লিখেন- "পদ্মা তোমার যৌবন চাই/ যমুনা তোমার প্রেম/ সুরমা তোমার কাজল বুকের/ পলিতে গলিত হেম।" সুরমার কাজল বুকের পলিতে গলিত হেম কবি দিলওয়ারের পাওয়া হয়েছ কি না জানিনা তবে তারুণ্যে ঘন্টাচুক্তি নৌকা নিয়ে 'হেম' নয় 'প্রেম' খুঁজতে সুরমার কাজল বুকে ঘুরে বেড়িয়েছি বহুদিন। কখনো শারদে নদীতীরে কাশবনের সন্ধান করেছি, কখনো পৌষের রোদমাখা দুপুর মাখামাখি করে কাটিয়ে দিয়েছি।
সিলেট নগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সুরমা নদীতে নৌকার সংখ্যা কম। খেয়াঘাটের নৌকা ছাড়া মাছ ধরার নৌকা এখন চোখেই পড়ে না। সে সময় ঘাসিটুলা এলাকায় নৌকা পাওয়া যেতো। দুই দশক পূর্বে সুরমা নদীতে এমন নৌভ্রমণ সাহসী পদক্ষেপ ছিল। মাঝিরা আমাদের আগ্রহের সাথেই নৌকায় তুলে নিতো। আমরা নদী ও আকাশ দেখতাম।এক পূর্ণিমার রাতে সুরমার জলে স্রেফ চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখবো বলে নৌকা ভাড়া করেছিলাম। উথালপাতাল জ্যোছনায় মাঝি সুর তুলে 'তুমি আসমানেরও চাঁদ/ আমি সুরমা নদীর নাইয়া/ একবার যদি দিতায় দেখা। চাননি ঘাটো আইয়া/'।
সুরমা দিয়ে গত দুই দশকে বহু জল প্রবাহিত হয়েছে। জীবনের চাওয়া ও পাওয়ার গল্পে বহু অনুগল্প যুক্ত হয়েছে। সেই মাঝিকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেই হয়ে গেছি 'সুরমা নদীর নাইয়া'। শুধু চান্নিঘাটে সেই চাঁদকে আসতে বলা হয়নি। তাই সে আসেনি। অভিমান করে জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু সুরমা নদী আমার জীবনে রয়ে গেছে। আমার জীবন ও কর্মের সাথে সুরমা নদী জড়িয়ে আছে। সুরমার ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলি। অংশীজনেরা সে সব কথাকে গুরুত্ব দেয়। গত দুই দশকে সুরমা নদী নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় অসংখ্য গণমাধ্যমে কথা বলেছি। সমস্যা চিহ্নিত করেছি, সমাধানের জন্য আন্দোলনে নেমেছি। নদীতীরের মানুষকে সংগঠিত করেছি। নদীর প্রতি দরদী প্রজন্ম সৃষ্টির জন্য স্কুলে স্কুলে প্রচারণা চালিয়েছি নদী বিষয়ক বিভিন্ন প্রদর্শনী নিয়ে।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা)-এর সাথে যুক্ত হই। সিলেটে গঠন করা হয় 'সিলেট পরিবেশ আন্দোলন (সিপা)। সিপা-র পক্ষ থেকে প্রথম কর্মসূচি পালন করি সুরমা নদী নিয়ে। সুরমার উজানে ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ক্বীন-ব্রীজের নিচে আয়োজন করা হয় প্রতিবাদ কর্মসুচীর। পরবর্তীতে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে অসংখ্য কর্মসুচী পালন করা হয়। সুরমার দখল-দূষণ নিয়ে সামাজিক আন্দোলন শুরু করি। বিভিন্ন এলাকায় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে নাগরিকদের সংঘবদ্ধ করে বহু কর্মসুচী পালন করি। সুরমার সাথে যুক্ত ছোট নদী, শাখা নদী, উপনদী রক্ষায় সরব হই। এভাবে চলে যায় আট বছর।
২০১৪ সালে নদী ও পানি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন 'ওয়াটারকিপার এলায়েন্স' আমাকে সুরমা নদীর মুখপাত্র হিসাবে সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল। আরো দশ বছর চলে যায়। আঠারো বছরে সুরমা নদীর পানি সুপেয় হয়নি। সুরমার দূষণ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তবে সুরমা নদী নিয়ে একের পর এক অসংখ্য কর্মসুচী পালন ও সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখা গেছে বলে সুরমা নদী দেশের অন্যান্য নদীর মত দখলের শিকার হয়নি। বরং জন আকাঙ্খা তৈরি হওয়ায় নগরীর বাণিজ়্যিক এলাকার দখল উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছে। প্রভাবশালীদের স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। নগরীর কাজির বাজার এলাকার প্রভাবশালী গোষ্ঠি নদীর জায়গা দখল করে নির্মাণ করেছিল 'বিলাসী শৌচাগার'। নিচতলায় শৌচাগার, দোতলায় বিশ্রামাগার। ছাদে ছিল ছাতার আদলে পাকা স্থাপনা। সিলেট নগরের কাজীরবাজার মৎস্য আড়তদার সমিতি নদীতীর দখল করে নির্মাণ করেছিল স্থাপনাটি। এলাকায় এটি পরিচিত ছিল ‘বিলাসী শৌচাগার’ হিসেবে। সেই শৌচাগার উচ্ছেদে সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হলে একাধিক কর্মসূচী পালন ও জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনকে যুক্ত করে তিন বছরের চেষ্টায় তা উচ্ছেদ করা হয়।
সুরমা নদীর সাথে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন রয়েছে। সুরমার মাতৃনদী হচ্ছে বরবক্র বা বরাক।তীর্থ চিন্তামণিতে বরবক্রের বা বারাক নদীর উল্লেখ যোগ্য বর্ণনা রয়েছে। অমরকোষ অভিধানে বর্ণিত ‘শরাবতী’ কে অনেকেই সিলেটের সুরমা নদী মনে করেন। এ সব কারনে সুরমা নদী হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র।
হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে আরব পর্যটক সোলায়মান ছয়রাফী পারস্য সাগর, ভারত সাগর ও বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করেন। তার বর্ণনায় বাংলার চট্টগ্রাম বন্দর ও সিলহেট বন্দরের কথা বারবার উল্লেখ আছে। আরবী ইতিহাসেও সিলহেট বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। মরক্কোর অধিবাসী শেষ আব্দুল্লাহ্ মোহাম্মদ ইবনে বতুতা হযরত শাহজালাল (র:) সাথে মোলাকাতের জন্য ১৩৪৬ খৃ: সিলেট আসেন। তিনি নহরে আজরক দিয়ে জলপথে সিলেট আসেন। আরবী আজরক এর অর্থ হল নীল রং। নহরে আজরক অর্থ হল সুর্মা। তাই সুরমা হয়েছে বরাক কন্যার নাম।
উতপত্তিস্থল থেকে সাগর সঙ্গম পর্যন্ত বিভিন্ন নামে প্রবাহিত সুরমা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০০ কিঃমি। যার মধ্যে ৫৬৪ কিলোমিটার ভারতে। ভারতের মনিপুর রাজ্যের সেনাপতি জেলার পউমাই (Poumai) অঞ্চলের লিয়াই ( Liyai kullen ) গ্রামের ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত উঁচু পাহাড়ের মাঝখানের তিনটি পৃথক ছোট স্রোত থেকে বরাক নদীর উৎপত্তি ( 25.43265104817024, 94.26410984832637 )। পউমাই সম্প্রদায় একে ভৌরী (Veorii) বলে থাকে। মনিপুর রাজ্যে বরাকের আরেক নাম তাইরং (Tuiruong)।
সুউচ্চ পর্বত থেকে প্রবাহকালে অজস্র ঝরনা বরাকে মিশেছে। যার মধ্যে আছে গুমতি, হাওড়া, কগনি, সেনাই বুড়ি, হরি মঙ্গল, কাকরাই, কুরুলিয়া, বালুঝুরি, শোনাইছড়ি, দুরদুরিয়া উল্ল্যখযোগ্য। এটি মণিপুরের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে নাগাল্যান্ডে ঢোকে, এবং তারপর দক্ষিণ পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে মনিপুর ও মিজোরাম রাজ্যের সীমানা ধরে আসাম রাজ্যে ঢোকে।
আসামের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুর এলাকা থেকে এটি বাংলাদেশের দিকে চলে যায় এবং সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার আমলসীদ ভাঙ্গা বাজার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মাত্র আড়াই কিমি ভারত-বাংলাদেশ সীমানা রেখা বরাবর প্রবাহিত হয়ে সুরমা আবার ভারতে প্রবেশ করে। আধ কিমি পর আবার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত রেখা বরাবর প্রায় ২৪ কিঃমিঃ জকিগঞ্জ উপজেলার আটগ্রাম ও ভারতের নাতানপুর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। এরপর সম্পূর্ণরুপেই বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। নাতানপুর পয়েন্ট থেকে আরো ১৫ কিমি প্রবাহিত হয়ে লোভামুখে এসে সুরমা নদী লোভা নদীর সাথে মিলিত হয়। লোভামুখ থেকে ৬ কিঃমিঃ প্রবাহের পর সুরমা নদী কানাইঘাট উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে গোলাপগঞ্জ অভিমুখে ছুটে যায়।
প্রায় ৪৭ কিঃমি পথ অতিক্রম করে গোলাপগঞ্জ পৌরসভার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিলেট মহানগরীর দিকে প্রবাহিত হয় সুরমা। প্রায় ১৭ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে সিলেট নগরীর ঐতিহ্যবাহী সিলেট সার্কিট হাউসের পাশে দিয়ে ছাতক-দোয়ারাবাজার হয়ে সুনামগঞ্জের পথে চলতে থাকে বাঁধনহারা এ নদী।
উৎস থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রবাহকালে কত রঙের মানুষের সাথে এ নদীর সাক্ষাত হয়। কত বর্ণের, কত জাতের, কত ভাষার মানুষ এই নদীর সাথে নিজেদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির মেলবন্ধন করেছে। মনিপুর পাহাড়ের গভীর অরন্য থেকে নেমে আসা বরাক নদী সুরমা হয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশে রাসসিক ভ্রমন করে আবারো কুশিয়ারা নদীর সাথে মেশে। এ দুই নদীতেই সিলেট বিভাগের প্রায় দুইশত নদীর সমাপ্তী হয়। সিলেটের মানুষ সুরমা ও কুশিয়ারাকে দুই বোন ও বরাক নদীকে মা হিসাবে তুলনা করে । জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসীদে মা বরাকের সমাপ্তি আর সুরমা-কুশিয়ারা দুই বোনের পথ চলার হয় শুরু। সিলেট বিভাগের চার জেলা পরিভ্রমণ করে সুরমা-কুশিয়ারা দুই বোনের পুনরায় মিলন হয়। সেই মিলনের নাম মেঘনা।
বরাকের পানির মূলধারা এখন কুশিয়ারা দিয়ে প্রবাহিত হয়। শুষ্ক মৌসুমে সুরমা নদী বরাক নদী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বরাকের পানি সুরমা দিয়ে প্রবাহিত হয় না। সুরমা সুষ্ক মৌসুমে শীর্ণকায় হয়ে বেঁচে থাকে কানাইঘাটের লোভাছড়া নদীর দয়ায়।
ভারত থেকে প্রবাহিত পাহাড়ি ছড়া লোভা। যা কানাইঘাটের লোভাছড়া চা বাগানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই ছড়া বা পাহাড়ি ছোট নদী সুরমার শুষ্ক দেহে পানি পৌঁছে দেয়। যা ধারন করে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা ক্ষীণকায় স্রোত নিয়ে সিলেট মহানগর অতিক্রম করে। সিলেট মহানগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা শুস্ক মৌসুমের সুরমা মূলত লোভা নদীর পানির প্রবাহ। লোভার সাথে মিলনের পরে সুরমা বিশ্বনাথ থেকে মিলিত হওয়া বাসিয়া নদী, ছাতকের আফজলাবাদ ইউনিয়নে ডাউকা নদী, জৈন্তা-গোয়াইনঘাট থেকে আসা সারি-গোয়াইন নদী, পিয়াইন নদী, দোয়ারাবাজার থেকে আসা জালিয়া নদী, চেলা নদী ও মেঘালয় পাহাড়ের ছোট বড় বিভিন্ন খাল ও ছড়ার মিলনে শক্তি সঞ্চয় করে ছাতক উপজেলা থেকে সুনামগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায় । সুনামগঞ্জে সুরমার সাথে মিশেছে বোগাপানি, জাদুকাটা, চলতি, সোমেশ্বরী, কংস, ধনু সহ আরো কিছু নদী ও ছড়া।
সুরমা শুধু নদী নয়। সুরমা এক পরম্পরা। তাই সুরমার কাজল বুকে মিশে আছে মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, বরাক উপত্যকা ও সিলেট বিভাগের মানুষ ও প্রকৃতির গল্প। সুরমাকে জানতে হলে সেই সব গল্পও জানতে হবে।
সিলেট, সুরমা নদী, স্মৃতিচারণ, সুরমা রিভার,