ছবিঃ হাওরে বোরো ধান কাটতে ব্যস্ত কৃষকেরা

সিলেট বিভাগের চার জেলার হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটার মৌসুম এখন তুঙ্গে। আগাম বৃষ্টির পূর্বাভাসে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যার আশঙ্কায় এবং শ্রমিক সংকটের সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে সময়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন কৃষকেরা। 
ফলে অনেকে কৃষকই ধান পুরোপুরি না পাকতেই কাটছেন—ভয় একটাই, যেন বিগত কয়েক বছরের মতো পানিতে ভেসে না যায় কষ্টের ফসল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায, এবার বিভাগে ৪.৯৭ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। শনিবার (২০ এপ্রিল) পর্যন্ত এর মধ্যে প্রায় ১.০৮ লাখ হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে।
এর মধ্যে গভীর হাওরাঞ্চলের ৩৩ শতাংশ ধান ইতিমধ্যে কাটা হয়েছে, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত উচু এলাকায় কাটা হয়েছে মাত্র ৬ ভাগ যার বেশিরভাগই বিভিন্ন স্থানীয় জাতের ধান।
দেশের শস্যভাণ্ডার সুনামগঞ্জে ২.২৩ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ক্ষেতের বোরোধানে পুরোপুরি পাক ধরার আগেই গত ১৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন সম্ভাব্য ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসে বন্যার আশঙ্কা জানিয়ে সব কৃষককে দ্রুত পাকা ধান কেটে ফেলার নির্দেশ দেয়।  
একই সাথে হাওরের সকল ধান কাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং কৃষি বিভাগের সব কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করা হয়।
তবে একই দিনে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) জানিয়েছিলো, আগামী তিন দিনে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে, তবে বন্যার সম্ভাবনা খুবই কম। তথ্যানুযায়ী, বন্যা পূর্বাভাস সঠিক ছিলো। ভারী বর্ষণ হলেও দেখা দেয়নি বন্যা।
তবে পরস্পরবিরোধী এমন বার্তা অনেক কৃষকের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে—তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, ধান আরও পাকতে দেবেন, নাকি এখনই কেটে ফেলবেন।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের কৃষক একলাছুর রহমান বলেন, “আমি ছয় একর জমিতে বোরো করেছি। প্রশাসনের বন্যা সতর্কতায় ৮০-৯০ শতাংশ পাকা অবস্থাতেই ধান কাটা শুরু করেছি।”
২০১৭ সালে ভয়াবহ আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলের প্রায় সব বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর থেকে আগাম আকস্মিক বন্যা হাওর অঞ্চলের কৃষকদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে।
এদিকে বন্যা ছাড়াও মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলের কৃষকেরা এবারও মুখোমুখি হয়েছেন অন্য সমস্যার। মৌসুমের শুরুতে খরার কারণে ধান অসমভাবে পাকছে। অনেক জমিতে পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। তার ওপর দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট।
মৌলভীবাজারের কাওয়াদিঘি হাওরপারের কৃষক আহমদ মিয়া বলেন, “বৃষ্টিপাতের অভাবে হাওরের অনেক জমি শুকিয়ে গেছে। ধানে পচন ধরেছে, পোকামাকড় ছড়িয়েছে। এখন চিন্তা একটাই—ফসল ওঠানোর আগেই যেন বন্যা না আসে।”
জেলার হাকালুকি হাওরের কৃষক সাদ্দাম হোসেন বললেন, “আমি তিন একর জমিতে আবাদ করেছি। এর মধ্যে দেড় একর কেটে ফেলেছি কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে। ফলন মোটামুটি ভালোই হয়েছে।”
হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার করাব গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, “ধান কাটার জন্য লোক পাচ্ছি না। স্থানীয় শ্রমিকরা অতিরিক্ত মজুরি চাইছে, তাও সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন অপেক্ষা করতে হচ্ছে কম্বাইন হারভেস্টারের।”
এ বছর সিলেট বিভাগে দুই হাজারেরও বেশি কম্বাইন হারভেস্টার কাজ করছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। এর মধ্যে ১,৮৫০টি স্থানীয়, বাকিগুলো বাইরের জেলা থেকে এসেছে। প্রতি বিঘা জমির ধান কাটতে খরচ হচ্ছে ১,৪০০ থেকে ২,০০০ টাকা।
এদিকে ধান কাটার পাশাপাশি কৃষকেরা ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়েও দুশ্চিন্তায়। অনেকেই আগাম বিক্রির চুক্তি করে ফেলেছেন, কারণ হাতে নগদ অর্থ নেই।
সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার বাগবাড়ি গ্রামের কৃষক শ্যামল সরকার বলেন, "আমার দুই একর জমির অর্ধেক ধান কেটে ফেলেছি, যদিও খরায় ফলন কিছুটা কম হয়েছে। কিন্তু বাজারে দাম নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। গত বছর মৌসুমের শুরুতে প্রতি মণ ধান ১,১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, আর শেষ দিকে দাম উঠেছিল ১,৪০০ টাকা পর্যন্ত। এবার দাম অনেক কম। ৯০০ টাকা প্রতি মণ ধান বিক্রি করতে হচ্ছে হাতে নগদ টাকা না থাকায়।”
সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, “যদিও খরা ও পোকামাকড়ে খুব অল্প কিছু জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে সার্বিকভাবে ফলন ভালো। বন্যার ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে আমরা কৃষকদের বলছি, ধান ৮০-৯০ শতাংশ হয়ে গেলে কেটে ফেলার জন্য।”

Single News Bottom

শেয়ার করুনঃ

কৃষি থেকে আরো পড়ুন

সিলেট হাওর, বোরো ধান কাটা, হাওরাঞ্চল, কৃষি সংবাদ, আগাম বন্যা, ধান কাটার মৌসুম, কম্বাইন হারভেস্টার, কৃষকের দুর্ভোগ, সুনামগঞ্জ ধান, ধান কাটার সমস্যা, কৃষি উৎপাদন সিলেট, মৌলভীবাজার হাওর, হবিগঞ্জ কৃষক