ছবিঃ একদিকে প্রায় পাকা ধান, অন্যদিকে অসমাপ্ত বাঁধ। ছবিটি সম্প্রতি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওর থেকে তোলা। ছবি: সিলেট ভয়েস।

সিলেট বিভাগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসল বোরো আবাদের আগাম জাতের ধান কাটা শুরু করেছেন কৃষকেরা। আবহাওয়া অনেকটা অনুকূলে থাকায় ভালো ফলনের আশা তাদের।

তবে আকস্মিক বন্যার শঙ্কা এবং হাওর রক্ষা বাঁধের মান নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন কৃষকেরা। তাছাড়া, তাপপ্রবাহের কারণে কিছু জায়গায় কীটপতঙ্গের আক্রমণ হয়েছে এবং কোথাও কোথাও নেক ব্লাস্টের সংক্রমণ বাড়াচ্ছে উদ্বেগ।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বিরইমাবাদ গ্রামের ইস্রাইল মিয়া বলেছেন, ‘গতবার বন্যায় আমন ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এবছর বোরো ধান ভালো দেখা যাচ্ছে। আমি ১০ একর জমিতে ব্রি-২৯ ও ব্রি-৮৯ আবাদ করেছি। আশা করছি ভালো ফলন হবে।’

সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট এবং হবিগঞ্জ জেলায় কৃষকরা এবছর ৪ লক্ষ ৯৭ হাজার ২১৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন, যা লক্ষ্যমাত্রা ৪ লক্ষ ৯৬ হাজার ৭৪৫ হেক্টরের চেয়েও বেশি বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। 

অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবছর মোট ২০ লক্ষ ৫১ হাজার টন ধান উৎপাদন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে, সরকারি বাজারদর অনুযায়ী যার মূল্য প্রায় ১০ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। 

হাওর অঞ্চলের অনেক কৃষকের জন্য বোরোধান একমাত্র প্রধান ফসল, তাই এই ফলন তাদের জীবিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফুলবাড়ী গ্রামের আবদুল হোসেন বলেন, ‘কয়েকদিন একটু বৃষ্টি হওয়ায় ধান ভালো হচ্ছে, কিন্তু এর ফলে হঠাৎ বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। আমার জমির পার্শ্ববর্তী ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ এখনো শেষ হয়নি, এখন বন্যা এলে আমার সব শেষ হয়ে যাবে।’

হাওরাঞ্চলের এলাকাগুলি আকস্মিক বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে ভারতীয় উজানে বৃষ্টিপাতের ফলে আসা ঢলের কারণে নিম্নাঞ্চল দ্রুত প্লাবিত হয়। ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যার পর থেকে আকস্মিক বন্যা বোরো উৎপাদনে একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরও একাধিকবার বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

প্রতিবছর সুনামগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলে বোরো ফসল রক্ষায় হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করা হয়। তবে এই প্রকল্পের মান ও কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে রয়েছে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা।

এই বছর সুনামগঞ্জে ৫৯৩ কিলোমিটার বাঁধ ৬৯৩টি প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ ও মেরামত করা হচ্ছে, যার খরচ ১২৮ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

২০১৭ সালের কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা অনুযায়ী হাওরে বাধেঁর কাজ ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করতে হবে। এবছর প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন ও হাওরের পানি নামার বিলম্বের কারণে ১৫ ডিসেম্বরের কয়েক সপ্তাহ পরেও কাজ শুরু হয়নি অনেক বাধেঁ। আবার ২৮ ফেব্রুয়ারি পর বর্ধিত ১০ দিন সময় নিয়েও শেষ হয়নি অনেক বাঁধের কাজ।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বাঁধ নির্মাণের মানের কঠোর সমালোচনা করেছেন। 

তিনি বলেন, ‘এই বছরের বাঁধের কাজ ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। ভারী বৃষ্টি এবং আকস্মিক বন্যা এলে অধিকাংশ বাঁধ ধসে পড়বে এবং সকল বোরো আবাদ বিনষ্ট হবে।’

পাউবো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, ‘সকল মৌলিক কাজ সময়মতো শেষ হয়েছে এবং সামগ্রিক অগ্রগতি ৯৭ শতাংশ। সামান্য কিছু কাজ বাকি রয়েছে এবং এইবছর কাজের সার্বিক মান ভালো।’

তিনি জানান, ‘এই বছর, আমরা সাতটি উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ বাঁধগুলো ব্লক দিয়ে শক্তিশালী করেছি, যা দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।’

এদিকে কিছু কৃষক পোকামাকড়ের আক্রমণ এবং ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে ক্ষতির কথা বলছেন যা সাম্প্রতিক শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে হয়েছে।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কৃষক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘এ বছর ধান ভালো দেখাচ্ছে, তবে আর্দ্র কিন্তু গরম আবহাওয়ার কারণে কীটপতঙ্গের আক্রমণ একটি বাড়তি উদ্বেগের বিষয়।’

মাটি আর্দ্রতা কম থাকায় কিছু এলাকায় খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যার ফলে জমি কীটপতঙ্গ এবং ছত্রাক সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সিলেট, সুনামগঞ্জ, এবং মৌলভীবাজারের কিছু এলাকায় সাম্প্রতিক বৃষ্টিপাত এই ঝুঁকিগুলোর মোকাবিলা করতে সাহায্য করেছে বলে মন্তব্য করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম। 

তিনি জানান যে পোকার আক্রমণ কিংবা রোগের সংক্রমণে বড় ধরণের ক্ষতির আশঙ্কা কম।

এই মৌসুমে কৃষকদের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো কৃষি শ্রমিকের অভাব। অনেক গ্রামীণ শ্রমিক শহরে ভালো বেতনে কাজ খুঁজতে চলে গেছেন, ফলে কৃষকদের জন্য শ্রমিক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা দশমন্তপুর গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক জ্যোতিমোহন দাস বলেন, ‘গত কয়েক বছরে তরুণরা কৃষিকাজে আগ্রহ হারিয়ে শহরে বিভিন্ন কাজের সন্ধানে চলে গেছে। এখন যারা কাজ করতে আসে তারা বেশি মজুরি দাবি করে ফলে সিজনে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়।’

তিনি বলেন, ‘কম্বাইন হারভেস্টার একটি ভালো বিকল্প, কিন্তু এলাকায় পর্যাপ্ত হারভেস্টার নেই। আবার বেশি বৃষ্টিতে জমিতে কাঁদামাটি জমলে তাতে হারভেস্টার ভালোভালো কাজ করতে পারে না। তখন সাধারণ শ্রমিক ছাড়া উপায় নেই।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, এবছর বিভাগে ১৭০০টি কম্বাইন হারভেস্টার প্রস্তুত আছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি যে সাধারণভাবে শ্রমিকের অভাব হবে না। শ্রমিকের সংকট তখনই প্রকট হয় যখন আকস্মিক বন্যার আশঙ্কায় কৃষকরা একসঙ্গে সব ফসল কেটে ফেলার চেষ্টা করেন।’

এদিকে মৌসুমের ধান কাটা পুরোদমে শুরু হবে ১৫ এপ্রিল থেকে। এ সময় কোনো অপ্রত্যাশিত ভারী বৃষ্টি বা উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ধ্বংস হতে পারে সারাবছরের সম্বল।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহ প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, ‘আমরা ৭২ ঘণ্টার বেশি আগে আগাম বন্যার পূর্বাভাস দিতে পারে না, যা সবসময়ই উদ্বেগের বিষয়।’

বিজন সেন রায় বলেন, ‘আমরা আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ করতে পারি না, তা ঠিক, তবে আমরা ভালো মানের বাঁধ দিয়ে আমাদের ফসল রক্ষা করতে পারি। এই বছর, সেটাই প্রধান উদ্বেগের বিষয়। আমরা এ বিষয়ে প্রেস কনফারেন্স করেছি, স্মারকলিপি জমা দিয়েছি এবং সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। যদি এবছর বাঁধের কাজের গাফিলতির জন্য ফসল ধ্বংস হয়, আমরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলবো।’

Single News Bottom

শেয়ার করুনঃ

কৃষি থেকে আরো পড়ুন

হাওর, বোরো ধান, ফসল, আবাদ, বন্যা, বাঁধ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, কৃষি,